ঝুঁকি, বিপদ এবং ক্ষতির মধ্যে পার্থক্য কি? আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ঝুঁকি বিশ্লেষণ করার উপায়

পৃথিবী এত জটিল যে, দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি সিদ্ধান্তের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম তারতম্য কেউই বুঝতে পারে না: কি খাবার খেতে হবে, ওষুধ গ্রহন করতে হবে, কোন পরিবহন ব্যবহার করতে হবে ইত্যাদি । বুঝতে পারি বা না পারি, মনোবিজ্ঞানীদের মতে একজন সাধারণ মানুষ দিনে প্রায় ত্রিশ হাজারের বেশি সিদ্ধান্ত নেয়, যার প্রতিটি সাথেই জড়িয়ে রয়েছে ঝুঁকি কেননা আমাদের কোনো সিদ্ধান্তই একেবারে ঝুঁকিমুক্ত নয় । ঝুঁকির পরিমাণ কম বা বেশি হতে পারে কিন্তু শূন্য হতে পারে না ।

সচেতনভাবে হোক বা না হোক, আমরা সবাই কম-বেশি ঝুঁকি বিশ্লেষণ করি। কিন্তু আমাদের মস্তিষ্ক প্রাকৃতিক অভিযোজনের ধারাবাহিকতায় শান্তিতে থাকতে চায়, স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে চায় এবং বেশী শক্তি ব্যবহার করতে পছন্দ করে না । যার কারনে, স্বাভাবিক ঝুঁকি বিশ্লেষনের সময় আমাদের মস্তিষ্ক যা আপাত নিরাপদ বলে মনে হয় সেরকম সর্বনিম্ন প্রতিরোধের পথ অবলম্বন করতে চায়। অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী ড্যানিয়েল কাহনেম্যান তার Thinking, Fast and Slow বইয়ে সুন্দরভাবে দেখিয়েছেন যে আমাদের মস্তিষ্কে দুই ধরনের চিন্তা পদ্ধতি  আছেঃ একটা কাজ করে কম শক্তি ব্যয়ে দ্রুত ও স্বয়ংক্রিয়ভাবে, এবং অন্যটা ধীর ও বিশ্লেষণাত্মক । পুরো বই জুড়ে রয়েছে বেশ কিছু সমস্যার উদাহরন, যার উত্তর দিতে গিয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা সহজ পথ ধরে ভুল করতে পারি । যেমনঃ একটি ব্যাট ও বল একত্রে ১১০ টাকা। ব্যাটের দাম বলটির থেকে ১০০ টাকা বেশি হলে বলের দাম কত? অনেকই বলবে বলটির দাম ১০ টাকা (উত্তরটি আসলে ৫ টাকা) । বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমরা চিন্তাধারার প্রথম পদ্ধতিদ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে পারি, তাই কম ঝুকিতে থাকার উপায় হল যতটা সম্ভব বিশ্লেষণাত্মক পথ অবলম্বন করা।

আমাদের কর্ম সম্পর্কে সচেতন এবং চিন্তাশীল হতে হবে। জানতে হবে ঝুঁকি বিশ্লেষণ করার বিভিন্ন পদ্ধতি সম্পর্কে । আর তবেই কোন কর্মের সাথে জড়িত ক্ষতি এড়ানো কিংবা কমানোর মতো সিদ্ধান্ত নেয়া আমাদের চিন্তা প্রক্রিয়ার অংশ হয়ে উঠতে পারে ।

ঝুঁকি, বিপদ এবং ক্ষতি

বেশিরভাগ মানুষ ঝুঁকি (Risk), বিপদ (Hazard) এবং ক্ষতি (Harm) শব্দগুলোকে সমার্থক হিসাবে ব্যবহার করে, কিন্তু ঝুকি বিশ্লেষণ করার জন্য এদের মধ্যে পার্থক্য বুঝা দরকার । এক কথায় বলতে গেলে, কোন বিপদের কারনে ক্ষতির সম্ভাবনাই ঝুকি । অনেক সময়ই আমরা সহজেই ক্ষতি বুঝতে কিংবা দেখতে পাই । তবে মনে রাখতে হবে, বিপদ না দেখলেও কিংবা ঝুকি না বুঝতে পাড়লেও, কোন ক্ষতি হলে অবশ্যই মানতে হবে এক বা একাধিক বিপদের উপস্থিতি সহ ঝুকি অর্থাৎ ক্ষতির সম্ভাবনা ছিল । 

চলুন একটা উদাহরন দিয়ে দেখি – কেউ করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে কোবিড রোগে অসুস্থ হলে বুঝতে হবে করোনাভাইরাস হলো বিপদ । অসুস্থ হওয়াটা ক্ষতি আর সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনাটাই হলো ঝুঁকি ।

আবার ধরুন কোন নির্দিষ্ট গন্তব্যস্থানে যাওয়ার সময় গাড়ি দুর্ঘটনায় কেউ আহত হল। এক্ষেত্রে গাড়ি এবং দুর্ঘটনা হল বিপদ (আরো সঠিকভাবে বলতে গেলে দুর্ঘটনাটি হলো বিপদের পরিতস্থিতি অর্থাৎ ক্ষতি হওয়ার পথ) আর আহত হওয়াটা হলো ক্ষতি আর ঝুকি দুর্ঘটনাটা ঘটার সম্ভাবনা কতোটা ছিল তা নির্দেশ করে । 

যদি আমরা এইগুলিকে বিশেষভাবে সংজ্ঞায়িত করতে চাই –

বিপদ এমন কিছু যা ক্ষতি ডেকে আনতে পারে অর্থাৎ ক্ষতির সম্ভাব্য উৎস যা বাস্তব-বস্তু অথবা পরিস্থিতি কিংবা এদুটি একসাথেও হতে পারে ।

স্বাস্থ্য, সম্পদ, সম্মান, পরিবেশ ইত্যাদির মতো কিছু হ্রাস বা হারানোই হলো ক্ষতি ।

ঝুঁকি ক্ষতির একটি আশঙ্কা নির্দেশ করে অর্থাৎ এটি সম্ভাবনা ছাড়া কিছুই নয় যা কোন ক্রিয়া বা নিষ্ক্রিয়তার কারনে বিপদ থেকে ক্ষতি বয়ে আনতে পারে।

উপরের উদাহরন দুটি থেকে আমরা দেখলাম যে, ঝুকি কোন বস্তু ও পরিস্থিতি এদুটির উপস্থিতির (বিপদ) উপর নির্ভর করে । যেমন একটি নির্দোষ চেয়ারও বিপদ হতে পারে । মনে করেন কোন পরিস্থিতিতে চেয়ার থেকে পড়ে গেলেন কিংবা অন্ধকারে তাতে হোঁচট খেলেন ।

ঝুঁকি বিশ্লেষণ করার উপায়ঃ

আমাদের প্রতিটি পছন্দ বা কর্মের অন্তর্নিহিত ঝুঁকি রয়েছে । সুতরাং, সবকিছুই ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে তা বিবেচনা করে, আমরা কীভাবে জীবনযাপন পরিচালনা করব এবং কীভাবে কার্যকরভাবে ঝুঁকি মূল্যায়ন করব তার জন্য জানা দরকার ঝুঁকি মূল্যায়নের উপায়।

নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ঝুঁকি মূল্যায়নের জন্য নানারকম পদ্ধতি ব্যবহার করেন – যার কিছু ব্যক্তিগত পর্যায়ে দৈনন্দিন জীবনে ঝুঁকি বিশ্লেষণের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। এখানে আমরা এই ধরনের দুটি পন্থা দেখব: একটি ঝুঁকি এড়াতে এবং অন্যটি ঝুঁকি কমাতে।

ঝুঁকি এড়ানোর উপায়ঃ

আমরা যদি কোন ক্ষতিকে বিভিন্ন অংশে ভাগ করি তবে দেখতে পাই যে নির্দিষ্ট ক্ষতির জন্য বিপদের একটি উৎস ও ক্ষতির গ্রহণকারী থাকে, এবং থাকে বিপদ ও গ্রহণকারী (যা কিনা ব্যক্তি, প্রানি কিংবা তাদের সম্পদ হতে পারে) একে অপরকে উম্মুক্ত করার পথ বা পরস্থিতি । তার মানে, কোন ক্ষতি হবার সম্ভাবনা অর্থাৎ ঝুঁকি আমরা দেখতে পারি নিচের সমীকরণ দিয়ে –

ঝুঁকি = উৎস x পথ x গ্রহণকারী

মজার ব্যাপার হল, আমরা যদি উপরেরে সমীকরণ থেকে উৎস, পথ কিংবা গ্রহণকারী কোন একটিকে সরিয়ে দিতে পারি তবে কোন ঝুঁকি থাকবেনা । ঝুঁকি বিশ্লেষণের এই উপায় টি source-pathway-receptor মডেল নামে ১৯৯০-এর দশকে ইংল্যান্ড এনভায়রনমেন্ট এজেন্সি উপস্থাপন করে এবং এখন অনেক পরিবেশগত বিশ্লেষনে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।

চলুন ব্যাপারটা গাড়ি দুর্ঘটনার উদাহরন দিয়ে আর একটু খোলাসা করি । আপনি কিংবা আপনার পরিবার এখানে গ্রহণকারী, গাড়ি উৎস, আর দুর্ঘটনা হলো পথ । এক্ষেত্রে ঝুঁকি তখনই থাকবে যখন ঐ তিনটি একই সময়ে উপস্থিত থাকবে। ধরুন আপনি ঐ যাত্রাটি বাতিল করলেন তাতে গাড়ি এবং দুর্ঘটনা দুটি হলেও যেহেতু ক্ষতির গ্রহণকারী (অর্থাৎ আপনি অনুপস্থিথ) তার কারনে আপনার স্বাস্থ্য ঝুকি শূন্য ।

করোনাভাইরাসে সংক্রমনের ক্ষেত্রে করোনাভাইরাস স্বভাবতই উৎস, আপনি (স্বাস্থ্য ক্ষতি) এখানে গ্রহণকারী, আর সংক্রমন হল পথ। অনেক করোনাভাইরাস থাকলেও কিংবা খুব বেশি সংক্রমণ হলেও আপনার ব্যক্তিগত ঝুঁকির পরিমাণ হবে শূন্য যদি না আপনি সংক্রমণ হতে পারে সেরকম পরিবেশে একেবারে না যান । এক্ষেত্রে উৎস ও পথ দুটিই আছে কিন্তু গ্রহণকারী হিসেবে আপনি অনুপস্থিত । আবার ভাইরাস আছে এবং আপনিও আছেন কিন্তু সংক্রমনের পথ নিখুঁতভাবে (যদিও তা প্রায় অসম্ভব) অনুপস্থিত সেক্ষেত্রেও ঝুঁকির পরিমাণ হবে শূন্য ।

ঝুঁকি এড়ানো মানে অনেক ক্ষেত্রেই কোন নির্দিষ্ট কর্ম বাতিল করা, যা সব সময় সম্ভব না কিংবা কাম্যও নয় । চলুন দেখি কিভাবে ঝুঁকি কমাতে পারি ।

ঝুঁকি কমানোর উপায়ঃ

ঝুঁকি মূল্যায়ন করতে নিরাপত্তা বিজ্ঞানীদের দ্বারা ব্যবহৃত আরেকটি  হল Swiss Cheese (সুইস পনির) মডেল। সুইস পনিরের প্রতিটি স্লাইসে অনেকগুলো ছিদ্র থাকে যার  অবস্থান এক স্লাইস থেকে অন্য স্লাইসে ভিন্ন হয় । এই মডেলে, সুইস পনিরের একটি টুকরা ঝুঁকি কমানোর জন্য নেওয়া একটি পদক্ষেপের প্রতীক। পনিরের প্রতিটি স্লাইস দুর্ঘটনার বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষার লাইন হিসাবে ভাবা যেতে পারে। যদি ছিদ্রগুলি একই লাইনে সারিবদ্ধ হয় তখন দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়ে যায়। অধ্যাপক জেমস রিজন ১৯৯১ সালে ঝুঁকি বিশ্লেষণের এই ধারনাটি দেন । এই মডেলের হিসাবে দুর্ঘটনা প্রায়শই অনেকগুলো আন্তঃসংযুক্ত কারনের সংমিশ্রণের ফলাফল। এটি বিমান যাত্রা ও চলাচল নিরাপত্তায় ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।

আমাদের গাড়ি দুর্ঘটনার উদাহরনের ক্ষেত্রে, একটি ভাল রাতের ঘুমসহ ড্রাইবেরর সার্বিক স্বাস্থ্য, যাত্রা শুরুর আগে গাড়ির টায়ার এবং সার্বিক অবস্থা পরীক্ষা করা, রাস্তার অবস্থা (কখন ব্যস্ত থাকে এবং মানচিত্র) সম্পর্কে জ্ঞান, আবহাওয়ার বিবেচনা, সিট বেল্ট ব্যবহার, ও প্রতি দুঘণ্টা অন্তর বিরতি নেয়া, প্রতিটিকে পনিরের একটি স্তর হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে যা দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমাবে কিন্তু স্বাধীনভাবে কোন একটি প্রতিরক্ষা স্তর সম্পূর্ণ সুরক্ষা দিতে পারবেনা।

আবার যদি করোনাভাইরাসে সংক্রমনের উদাহরণটি বিবেচনা করি তবে ঝুঁকি কমানোর জন্য এই বহুস্তরযুক্ত পদ্ধতিটিও ব্যবহার করা যায় । এক্ষত্রে সামাজিক দূরত্ব, মাস্ক ব্যবহার, হাত ধোয়া, বায়ুচলাচল করে এমন পরিবেশ রাখা, জনসমাগম এড়িয়ে চলা, জনসমাগমে সল্প সময় ব্যয় করা, এলাকার সংক্রমনের খবর রাখা, এবং টিকা নেয়া প্রতিটি একটি প্রতিরক্ষা স্তর যেগুলো একসাথে সংক্রমনের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করবে।

সচেতনভাবে একটু মনযোগী হয়ে ঝুঁকি বিশ্লেষণ করলে আমরা অনেক ক্ষত্রেই ক্ষতি এড়াতে পারব । ঝুঁকি বিশ্লেষণের মধ্যমে ছোট ঝুঁকিগুলিকে চিহ্নিত করা এবং বড় ঝুঁকিগুলির উপর নজর রাখা ও যথাযথ সুরক্ষা ব্যবস্থা নেয়াই মুল কথা । ঝুঁকি মূল্যায়নের চূড়ান্ত ধাপ হল নিষ্কৃতি নেই এমন অনিবার্য ঝুঁকি যা আর কমানো যাবে না তা মেনে নেয়া ।  

Sources consulted: Harvard School of public health & NY Times Accessed on 28 Dec 2021; Thanks to Sufia Sultana for her helpful comments on an earlier version of the text.

ফিচার ফটোঃ pixabay.com

লেখকঃ মোহ বাঙ্গালি

About সময় চাকা

আমরা বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসরত কিছু বাংলাদেশী। সময়ের চাকায় আমরা চলেছি সুখের সন্ধানে, সেই প্রস্তর যুগ থেকে শুরু করে আজও চলছে সন্ধান আর অনুসন্ধান । তাই চলুন সময়ের চাকায় পিষ্ট না হয়ে, সময় চাকা ধরে চলতে থাকি, সময়কে সুন্দর করে রাখার আশায়…

2 thoughts on “ঝুঁকি, বিপদ এবং ক্ষতির মধ্যে পার্থক্য কি? আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ঝুঁকি বিশ্লেষণ করার উপায়

  1. খুব ভালো বিশ্লেষণ করেছেন জনাব মোহ বাঙ্গালী । অনেক ধন্যবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *