আমাদের উৎসব উদযাপনের প্রয়োজনীয়তা ও পিছনের বিজ্ঞান

আপনি এই মানব পৃথিবীর যে প্রান্তেই যান তিনটি জিনিস পাবেনঃ গান, ধর্ম ও উৎসব । উৎসবই অনেক সময় গান বা ধর্ম এবং মানুষের মাঝে সেতুবন্ধনের কাজ করে । কিন্তু কখনও কি ভেবে দেখেছেন কেন আমরা উৎসব উদযাপন করি কিংবা আছে কি এর পেছনে কোনো বৈজ্ঞানিক যুক্তি বা কারন?

মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে প্রধান পার্থক্য কী? আপনি হয়তো অনেক পার্থক্যের তালিকা হাজির করতে পারবেন যেমনঃ মানুষ পাথর ছুঁড়তে পারে, গল্পকে (টাকা, দেশ এবং আইন মানুষের তৈরি গল্পের কয়েকটি উদাহরণ) সত্য হিসাবে বিশ্বাস করতে পারে ইত্যাদি । সম্ভবত সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ পার্থক্য হল মানুষ যে সহযোগি হিসাবে কাজ করতে পারে । আপনি কি বলতে পারেন, যে মোবাইল ফোন বা কম্পিউটার এই লেখাটি পড়ার জন্য ব্যবহার করছেন তা কতজন লোকের সহযোগিতা ও সমন্বয়ের ফল? যদি কাঁচামাল থেকে আপনার দরজায় এর সরবরাহ পর্যন্ত অন্তর্ভুক্ত করেন তবে এটি বিভিন্ন দেশ থেকে লাখ খানেক না হলেও কয়েক হাজারের মতো হবে। এই বিশাল স্তরের সহযোগিতা অন্য কোনও প্রাণীর পক্ষে সম্ভব নয় । আমরা একদিনে এই দক্ষতা অর্জন করিনি। হাজার হাজার বছর আগে আফ্রিকাতে এই দক্ষতার বিকাশ শুরু হয়েছিল এবং বিভিন্ন উৎসবের উদযাপন ছিল এই প্রক্রিয়ার কেন্দ্রবিন্দুতে । মানব সভ্যতার শুরুতে গোত্রের বিভিন্ন সদস্য কিংবা বিভিন্ন গোত্রের মিলন হতো বিভিন্ন উৎসবের মাধ্যমে, আর কালক্রমে অনেক গোত্রের সম্মিলনে তৈরি হয়েছে বড় গোত্রের এবং আজকের দুনিয়া ।

উৎসব কি?

উৎসব মানুষের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে । আর সভ্যতা ও সংস্কৃতি এর ঐতিহ্যের ধারা অনুযায়ী রোজকার রুটিন থেকে বের হয়ে সুখ দুঃখ নির্বিশেষে একসাথে কিছু সময় অতিবাহিত করাই মুলত উৎসব । এটা হতে পারে পরিবারিক, সামাজিক কিংবা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ।

মানুষ সহজাতভাবে জীবনের উল্লেখযোগ্য মুহূর্তগুলিকে সম্মান করার জন্য চালিত, যেমন একটি সুখী সম্পর্ক, সন্তানের জন্ম, পেশা বা ব্যক্তিগত বিজয় এবং অন্যান্য মাইলফলক । অন্যদিকে প্রিয়জনকে হারানো বা বিপর্যয়ের মুখোমুখি হওয়া জগতজোড়া  শোকের বিষয়।

মানুষের উৎসবের সংখ্যা প্রায় অন্তহীন এবং অবিশ্বাস্যভাবে বৈচিত্র্যময়। বর্তমানে জন্মদিনও অনুষ্ঠান হিসাবে পালন করে থাকে সারা পৃথিবীর মানুষ। এমনকি ক্লান্ত মানুষ সপ্তাহিক বন্ধের দিনটিও উৎসবের আমেজেই কাটাতে ভালোবাসে।  উৎসব উদযাপনের রয়েছে হাজারেরও বেশি উপায় ।

এইসব তো রোজকার উৎসবের বাহিরে রয়েছে ধর্মীয় (ঈদ, বড়দিন, দিওয়ালী উৎসব,বুদ্ধ পূর্ণিমা), সামাজিক (নববর্ষ, হেলোয়িন), ও জাতীয় (স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস) উৎসব যা কিনা থাকে সাধারন ছুটি। সেইসব দিনে কোন কাজ হবে না, হবে শুধু আনন্দ। প্রাচীনকালে মানুষ আনন্দ অনুষ্ঠান করতো তাদের প্রধান কর্ম কৃষিকে (ফসল কিংবা পশু) কেন্দ্র করে। কিন্তু কর্ম কেন্দ্রিক প্রাচীন অনেক উৎসবই বিভিন্ন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে অধিকৃত হয়েছে ।

উৎসবের প্রয়োজনীয়তাঃ

পৃথিবীতে নানান ধর্মের মধ্যে নানান বৈচিত্র্য আর তার সাথে তাল মিলিয়ে বিভিন্ন উৎসবেও রয়েছে বৈচিত্র্য । ভিন্ন ধর্মীয় উৎসবের আধ্যাত্মিক উদ্দেশ্য যেমনই হোক না কেন পার্থিব দিক থেকে মানুষকে কাছাকাছি নিয়ে আসাটাই মূল । অনেক উৎসবই আমাদেরকে অতীতের সাথে সংযোগ সাধন করার সাথে সাথে অন্তর্ভুক্ত করে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আনন্দের সাথে । যেমন ধরুন বড়দিনের কথা, পুরো ইউরোপে বিভিন্ন ধর্মের মানুষজন আছে; তবে সবাই এসময় একটা ছুটি পায় । বাহিরে রাস্তাঘাটে  সমস্ত জায়গায় এক ধরনের আনন্দের ঘনঘটা থাকে । আর এসব কারনে বড়দিন এখন পরিণত হয়েছে ইউরোপিয়ান ট্র্যাডিশনে । ট্র্যাডিশন অর্থাৎ ঐতিহ্য প্রায়শই ধর্মীয় সীমানা অতিক্রম করে সবাইকে আনন্দের অনুভূতি দেয় । এই শীতকালীন উৎসবকালীন ছুটির দিনগুলি অ-খ্রিস্টানদের জন্যও হতে পারে প্রতিফলিত এবং প্রিয় স্মৃতি রোমন্থনের আসল সময় কেননা তখন ব্যস্ততা থাকে কম।

কিছু অনুষ্ঠান আছে যেগুলো অনুষ্ঠিত হয় কোন নির্দিষ্ট স্থানে, নির্ধারিত সময়ে। সেসব অনুষ্ঠানের আয়োজনের খরচ হয় লাখ লাখ টাকা, অনেক সময় অনুষ্ঠান হয় একদিন কিংবা দুই দিন কিন্তু তার জন্য প্রস্তুতি চলে কয়েক মাস জুড়ে । এধরনের সমষ্টিগত এবং সশরীরে উপস্থিত হওয়া উৎসবের একটা সুগভীর প্রতিকি মূল্য রয়েছে । কেননা এ ধরণের উৎসবে নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট স্থানে, নির্দিষ্ট সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সাথে জড়িত হয়ে বড় একটা কিছুর সাথে সম্পৃক্ত অনুভূতি জাগাতে পারি এবং তৈরি করতে পারি অর্থপূর্ণ স্মৃতি ।

সম্ভবতক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল যে আমরা কোন উৎসব উদযাপনের সময় শারীরিক বীরত্বটা ও মানসিক ভাবগাম্ভীর্যতা বাদ দিয়ে উৎসবে যোগ দেই । ফলে বিভিন্ন উৎসব উদযাপন শুধু আমাদের জীবনে মজা এবং উত্তেজনাই যোগ করেনা বরং – 

  • আমাদের পরিবার এবং বন্ধুদের সাথে বন্ধনের সবচেয়ে উপযুক্ত সময় হল বিশেষ অনুষ্ঠানের সময়। 
  • প্রথাগত আচার-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা অনেক সময় জীবনের অর্থ এবং তাৎপর্য বুঝতে সহায়তা করে। 
  • দীর্ঘস্থায়ী ভালোলাগার স্মৃতি আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য খুবই দরকারি । কেননা আমাদের মাথা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অডিও ভিজুয়াল ব্যবস্থাপনা যেখানে আপনি চাইলেই হারিয়ে যেতে পারেন । বিভিন্ন উৎসব উদযাপনের আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা ও স্মৃতি হতে পারে  মানসিক রিচার্জের খোরাক । 
  •  নতুন নতুন মানুষের সাথে পরিচয় এবং নতুন সংস্কৃতি সম্পর্কে জানা  ।
  • সময় একটা জীবনে খুবই সংকীর্ণ কিন্তু কিছু কিছু আচার অনুষ্ঠান হাজার বছরের পুরাতন । অনেক সময় এসব আচার অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আপনি সেই হাজার বছরের এবং পূর্বপুরুষদের সাথে নিজেকে যুক্ত করতে পারবেন ।
  • পেশা বা ব্যক্তিগত যেকোনো সাফল্যের উদযাপন পরবর্তী সাফল্যের প্রয়োজনীয় জ্বালানী অর্থাৎ ফোকাস এবং কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে ! 

উৎসবের বিজ্ঞান

ব্যক্তি পর্যায়ে উৎসব আমাদের মস্তিষ্কে এন্ডোরফিন নামক রাসায়নিকের নিঃসরণ ঘটাতে পারে যা কিনা আমাদের মানসিক চাপ ও উদ্বেগ হ্রাস করে এবং আনন্দ সুস্থতার অনুভূতি বৃদ্ধি করে । বন্ধন ও উৎসব ওতপ্রোতভাবে জড়িত । পারিবারিক উৎসব পারিবারিক বন্ধন বাড়াচ্ছে, সামাজিক উৎসব সামাজিক বন্ধন বাড়াচ্ছে,  রাষ্ট্রীয় উৎসব ধীর করছে রাষ্ট্র এবং নাগরিকের মধ্যে বন্ধন । ধর্মীয় উৎসব অন্যদিকে দিচ্ছে আধ্যাত্বিক প্রশান্তি আর বাড়াচ্ছে ভাতৃত্বের সম্পর্ক রাষ্ট্রের আইন সীমার বাইরেও ।

মূলত উৎসবই আমাদের মানুষ বানিয়েছে । কেননা সেই প্রাগৈতিহাসিক কালে আমরা বিভিন্ন গোত্রে বসবাস করতাম, সেই গোত্র থেকে রাষ্ট্র আর এই দুনিয়া সবই সম্ভব হয়েছে উৎসবের ভিতর দিয়ে । উৎসব আর বৃহৎ ধর্মগুলিই আমাদের শিখিয়েছে কিভাবে বৃহৎ আকারে সহযোগি (যদিও এখন আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক লেনদেন ও জনস্বাস্থ্যের বিজ্ঞান ব্যাপারটি নিয়ন্ত্রন করে) হিসাবে কাজ করতে হয় ।

ফিচার ফটোঃ pixabay.com

লেখকঃ মোহ বাঙ্গালি

#The translation may not be completely accurate, and it may even distort the meaning and accuracy of the facts.

About সময় চাকা

আমরা বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসরত কিছু বাংলাদেশী। সময়ের চাকায় আমরা চলেছি সুখের সন্ধানে, সেই প্রস্তর যুগ থেকে শুরু করে আজও চলছে সন্ধান আর অনুসন্ধান । তাই চলুন সময়ের চাকায় পিষ্ট না হয়ে, সময় চাকা ধরে চলতে থাকি, সময়কে সুন্দর করে রাখার আশায়…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *