শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা, ভ্যাকসিন (টিকা) ও বুস্টার ডোজ কিভাবে কাজ করে?

করোনাভাইরাস কিংবা অন্যান্য  সর্দি-কাশিসহ বিভিন্ন রকমের  রোগ বিমারি মানুষের কম বেশি লেগেই থাকবে । বর্তমানে প্রায় দুইশত সর্দি-কাশির জীবাণু রয়েছে । এই ধরুন করোনাভাইরাস এখন যে অবস্থায় আছে সেটা কিন্তু আর আমাদের ছেড়ে যাচ্ছে না । তবে আশার বিষয় হলো শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা আমাদেরকে এইসব রোগ বিমারির হাত থেকে সর্বদাই রক্ষা করে চলেছে ।

আপনি কি জানেন যে আমাদের শরীরের স্নায়ুতন্ত্র এবং রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত কঠিন ও জটিল বিষয়, যা বিজ্ঞানও এখনো পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেনি । তবে সাধারণভাবে যদি আমরা এই রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে বুঝতে পারি তবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে এর থেকে কিছু সুবিধা পাওয়ার সুযোগ রয়েছে । 

শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা

ইমিউন সিস্টেম অর্থাৎ রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা জীবাণু এবং অন্যান্য যেকোনো বহিরাগত বস্তু যার আমাদের শরীরে কোন কাজ নেই তার মূলোৎপাটন করতে কাজ করে । এ ব্যবস্থাটিই খুবই সুনিপুণ ।

সাদাসিধেভাবে দেখলে, এটিকে তুলনা করা যেতে পারে রাজপ্রসাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সাথে । যেমন ধরুন  রাজপ্রসাদের বাহিরে মোটা দেওয়াল কিংবা পানি দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকে তেমনি আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার প্রাথমিক প্রতিরক্ষা হলো চামড়া, মিউকাস মেমব্রেন (যা নাক, গলা ও ফুস্ফুসসহ শরীরের অনেক জায়গায় থাকে), কানের খৈল ও নাকের ভিতরের লোম ইত্যাদি । জীবাণুভরা এই পৃথিবীতে আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার প্রাথমিক এই প্রতিরক্ষা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের জীবানু থেকে রক্ষা করতে পারে । 

আর যখন মাঝেমধ্যে প্রাথমিক প্রতিবন্ধকতা ভেঙে পড়ে তখন আমাদের ভিতরগত রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা কার্যকর হয়ে ওঠে, মোটামোটি যেমনভাবে রাজপ্রসাদের ভিতরের সৈন্য-সামন্ত সুম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হয় । তবে আমাদের শরীর এব্যাপারটা করে অত্যন্ত সুনিপুণ সুকৌশলে । 

উদাহরণস্বরূপ ধরুন আপনার চামড়া কোথাও কেটে গিয়ে শরীরের ভিতরে কোন একটা জীবাণু ঢুকে পরল,  যাকে সাধারণত এন্টিজেন বলা হয় অর্থাৎবহিরাগত বস্তু । আমাদের রক্তে লোহিত কণিকা অনুচক্রিকা ও শ্বেত কণিকা থাকে । আমাদের অস্থি মজ্জায় তৈরি ওই তিন ধরনের রক্ত কণিকার মাঝে শ্বেতকণিকা আবার বিভিন্ন রকমের আছে কিন্তু তাদের সাধারন কাজ হল রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থায় মুখ্য ভূমিকা রাখা । 

শ্বেতকণিকার রকমফের এর মধ্যে মূলত বি-লিম্ফোসাইট ও টি-লিম্ফোসাইট উল্লেখযোগ্য । বি-লিম্ফোসাইটের কাজ হল কোন একটা এন্টিজেনের বিরুদ্ধে এন্টিবডি তৈরি করা এবং ওই এন্টিজেনের চেহারা মনে রাখা যাতে ভবিষ্যতে আক্রমণ করলে তাড়াতাড়ি তাকে প্রতিহত করতে পারে । আর শরীরের ভিতরে কোষের বাহিরে  যদি কোন এন্টিজেন মুক্তভাবে ঘোরাঘুরি করে তাদের বিরুদ্ধে কাজ করাই এর কাজ । অন্যদিকে টি-লিম্ফোসাইট, আমাদের হূদযন্ত্রের কাছাকাছি থাইমাস গ্লান্ডে তৈরি হয়, যার কাজ মূলত আক্রান্ত কোষকে ধ্বংস করা অর্থাৎ ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত কোষকে নিষ্ক্রিয় করা । আমরা এখন দেখবো এই জিনিসটা কিভাবে শুরু হয় ।

শ্বেত রক্তকণিকার আরেকটি হলো ম্যাক্রোফেজ যা কিনা এন্টিজেনকে মোটামুটি গিলে খায় অর্থাৎ কোষের ভিতরে নিয়ে যায় যেখানে এটি এক ধরনের এনজাইম দিয়ে ওই এন্টিজেনকে টুকরো টুকরো করে ফেলে । ম্যাক্রোফেজ ওই এন্টিজেনের টুকরো গুলোকে কোষের আবরণের উপরে নির্দিষ্ট অবয়বে আটকে রাখে । তখন শ্বেতকণিকার অন্য আরেকটি ধরন, যা হেল্পার-টি সেল বলে পরিচিত, এক ধরনের প্রোটিনের সহায়তায় ওই এন্টিজেনের টুকরোর অবয়বকে নকশা করে রাসায়নিক সংকেত ছড়াতে থাকে যা বি-লিম্ফোসাইট কে নকশা মোতাবেক এন্টিবডি তৈরি করতে উদ্বুদ্ধ করে । তৈরি হওয়া এসব এন্টিবডি মুক্তভাবে ঘুরে বেড়ানো এন্টিজেন অর্থাৎ জীবাণুর গায়ে চারদিক থেকে আটকে ধরে যার কারণে ওটি নতুন কোন কোষকে আক্রমণ করতে পারে না । ওই পরিস্থিতিতে এন্টিবডি ঘিরা এন্টিজেন কে ম্যাক্রোফেজ ধরনের শ্বেত রক্তকণিকারা গিলে নিতে পারে ।

এখানে আমরা দেখছি কিভাবে আমাদের এন্টিবডি ও কিলার টি-সেল কোন জীবাণুর বিরুদ্ধে কিভাবে শরীরের কোষের বাহিরে এবং কোষ পর্যায়ে কাজ করে সুরক্ষা দেয় । 

হেল্পার-টি সেল এখানে আরো ম্যাক্রোফেজকেও সক্রিয় করে তুলতে সাহায্য করে এবং টি-লিম্ফোসাইটকেও (কিলার টি-সেল) উদ্বুদ্ধ করে আক্রান্ত কোষকে ধ্বংস করার কাজে লিপ্ত হওয়ার জন্য ।

এখানে দেখছেন  হেল্পার-টি সেল খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনাকে সক্রিয় করে তুলতে এককভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে । যাদের এইডস হয় তাদের  হেল্পার-টি সেলের ক্ষমতা কমে যায়, যার কারনে তারা বিভিন্ন স্বাভাবিক রোগের বিরুদ্ধেও প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলতে পারে না । 

চলুন দেখি করোনাভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ব্যাপারটা । ধরুন আপনি করোনাভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হলেন । আক্রান্ত হওয়ার পর পরই আপনি তেমন কিছুই বুঝতে পারবেন না কারণ প্রথম দুই তিন দিন শরীরের ভিতরে করোনাভাইরাস তার অনেক অনুলিপি তৈরি করবে এবং তখন শরীর  পর্যাপ্ত পরিমাণে এন্টিবডি ও কিলার টি-সেল তৈরি করে ভাইরাসের বিরুদ্ধে মোটামুটি যুদ্ধ ঘোষণা করে ওই সময়ে আমরা অসুস্থতা অনুভব করতে শুরু করি ।  এই অসুস্থতা আসলেই রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থারই একটা অংশ এবং অল্প কিছুদিন আমরা সে অসুস্থতা কাটিয়ে সুস্থ হয়ে উঠি।

শরীর ইতিমধ্যেই করানোভাইরাসের বিরুদ্ধে অর্থাৎ ঐ ভেরিয়েন্ট এর বিরুদ্ধে মেমোরি বি ও টি সেল তৈরি করে যা কিনা ভবিষ্যৎ পুনরায় একই জীবাণুদ্বারা আক্রান্ত হলে সহজেই সুস্থ হয়ে উঠতে সাহায্য করে । ধরুন কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে আবার করোনাভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হলেন, সে ক্ষেত্রে আপনি টের পাওয়ার আগেই শরীরের এন্টিবডি ওই ভাইরাসকে প্রতিহত করে দিল । আপনি কোন রকমের উপসর্গের সম্মুখীন হলেন না । কিন্তু ধরুণ বছরখানেক পর ওই ভাইরাসের সম্মুখীন হন তবে হয়তো আপনি কিছু উপসর্গ দেখাতে পারেন কেননা সময়ের সাথে এন্টিবডি কমতে থাকে কিন্তু যেহেতু ওই ভাইরাসের মেমোরি বি ও টি সেল রয়েছে তারা অল্প সময়ে খুব খারাপ কিছু হওয়ার আগেই করোনাভাইরাস কে প্রতিহত করতে পারবে ।

রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনা শরীরের জন্য খুবই ব্যয়বহুল এবং বেশি সময় ধরে এটা চলতে থাকলে উপসর্গ সমূহ শরীরের বিভিন্ন অন্ত্রের ক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে তুলতে পারে আর তখনই জীবন-মরণ পরিস্থিতির কথা আসে । 

কিন্তু মনে রাখবেন এক এন্টিজেন অর্থাৎ জীবাণুর এন্টিবডি অন্য জীবাণুর বিরুদ্ধে কোন কাজ করবে না । সেক্ষেত্রে আবার নতুন করে শুরু করে ওই নতুন জীবাণুর বিরুদ্ধে এন্টিবডি ও মেমোরি সেল তৈরি করতে হয় ।  উদাহরণস্বরূপ, হামের অ্যান্টিবডি এমন একজন ব্যক্তিকে রক্ষা করবে যখন হামের রোগের সংস্পর্শে আসে কিন্তু যদি সে মাম্পসের সংস্পর্শে আসে তবে হামের অ্যান্টিবডির কোনো প্রভাব থাকবে না।

টিকা ও বুস্টার ডোজ

টিকা অর্থাৎ ভ্যাকসিনগুলি আপনার শরীরকে অল্প পরিমাণে (সাধারণত একটি নিহত বা দুর্বল) ভাইরাসের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে আপনার ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে চালু করে । আপনার শরীর প্রতিক্রিয়া হিসাবে অ্যান্টিবডি তৈরি করে যা হাম , হুপিং কাশি,  মেনিনজাইটিসের কিংবা করোনাভাইরাসের মতো জীবাণুর হুমকি থেকে রক্ষা করে । তারপরে, আপনি যখন দৈনন্দিন জীবনে সেই ভাইরাসের সংস্পর্শে আসেন, তখন আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ইতিমধ্যেই শুরু হয় যাতে আপনি অসুস্থ না হন।

টিকা দেয়া বা ইমিউনাইজেশন হল একটি নির্দিষ্ট জীবাণুর বিরুদ্ধে আপনার ইমিউন সিস্টেমকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার একটি উপায়।এই প্রশিক্ষণ দেওয়াকে আপনার শিক্ষার সাথে তুলনা করতে পারেন, যেমনটি করা হয়েছিল বিবিসির সাম্প্রতিক একটা প্রবন্ধেঃ প্রথম ডোজ টিকা নেয়ার পর মনে করলেন আপনার শরীর ওই জীবাণুর বিরুদ্ধে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষা পেল । দ্বিতীয় ডোজ আপনার রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা, আর বুস্টার ডোজ দিবে  বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ । এখানে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, একটা টিকা নেয়ার পরে আমাদের শরীরে যে এন্টিবডি তৈরি হয় সেগুলো সময়ের সাথে কমতে থাকে । এই এন্টিবডিগুলো প্রাথমিকভাবে  ওই নির্দিষ্ট জীবাণু প্রবেশ করলে তাকে সহসাই নিষ্ক্রিয় করার কাজে লিপ্ত হয় এবং তেমন কোনো উপসর্গ ছাড়াই আমরা ওই জীবাণুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী অর্থাৎ সুস্থ হয়ে ওঠি ।

প্রথমবারের মতো কোন জীবাণুর সংস্পর্শে আসি, এন্টিবডি তৈরির পাশাপাশি কিছু মেমোরি সেল তৈরি করে যা কিনা ভবিষ্যতে ওই জীবাণুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার ব্যবস্থাপনা মনে রাখে । কিন্তু এই মেমোরির সেলের কাজ কারবারগুলো সক্রিয় হতে একটু সময় নিতে পারে যার কারণে কিছু উপসর্গ দেখা দিতে পারে । কিন্তু বুস্টার ডোজ আমাদের শরীরে ওই এন্টিজেন নিষ্ক্রিয় করার এন্টিবডি (neutralising antibody) লেভেল পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে উপসর্গহীনভাবে সহসাই সুস্থ হয়ে করতে সাহায্য করতে পারে । 

বয়স বাড়ার সাথে সাথে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমতে পারে। এটি আপনার অসুস্থ হওয়ার বা সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলতে পারে। 

আমরা কি করতে পারি

আশার কথা হলো যেসব কাজের মাধ্যমে আপনি আপনার হৃদয়, মস্তিষ্ক ও হাড়ের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে পারেন সেসব কাজ আপনার রোগ  প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে ভালো হতেও সাহায্য করতে পারে । আর এই কাজগুলো স্বাভাবিকভাবেই:

  • সক্রিয় থাকা।
  • ওজন সুস্থ পর্যায়ে রাখা।
  • ধূমপান না করা।
  • অ্যালকোহল পান না করা কিংবা তা পরিমিত রাখা
  • পুষ্টিকর ও ভিটামিন এবং খনিজ সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া।
  • মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রনে রাখা ।

তবে মনে রাখবেন নতুন কোনো সংক্রামক রোগের জীবাণুর বিরুদ্ধে অপ্রয়োজনীয় ঝুঁকি না নিয়ে টিকা নেয়ার সুযোগ থাকলে তা দিয়েই প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে প্রশিক্ষিত করা আমাদের কাম্য । যা কিনা আমরা সম্প্রতিক করোনাভাইরাস সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য করে যাচ্ছি । 

সবাই সুস্থ থাকুন ও অন্যকে সুস্থ থাকতে সাহায্য করুন । 

Simplified based on https://teachmephysiology.com/immune-system/ Accessed on 18 Dec 2021; Thanks to Dr Sabiha Afrin for her helpful comments on an earlier version of the text.

ফিচার ফটোঃ pixabay.com

লেখকঃ মোহ বাঙ্গালি

About সময় চাকা

আমরা বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসরত কিছু বাংলাদেশী। সময়ের চাকায় আমরা চলেছি সুখের সন্ধানে, সেই প্রস্তর যুগ থেকে শুরু করে আজও চলছে সন্ধান আর অনুসন্ধান । তাই চলুন সময়ের চাকায় পিষ্ট না হয়ে, সময় চাকা ধরে চলতে থাকি, সময়কে সুন্দর করে রাখার আশায়…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *