জলবায়ু পরিবর্তন বন্ধে ১০ টি কাজ যা কিনা ব্যক্তি পর্যায়েও অর্থনৈতিক এবং স্বাস্থ্য সুবিধা দিবে ।

জলবায়ু পরিবর্তন হলো একটি জায়গার বৃষ্টিপাত অথবা উষ্ণতার স্বাভাবিক মাত্রা কিংবা ধরনের পরিবর্তন । পৃথিবীর তাপমাত্রা গত ১০০ বছরে প্রায় এক ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বেড়েছে । আর এটি অন্য যেকোন সময়ের চেয়ে দ্রুত গতিতে বাড়ছে । তাপমাত্রার এ পরিবর্তন খুব বেশি মনে না হলেও প্রভাব ভয়াবহ, কেননা এর সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে মাত্রাতিরিক্ত বৃষ্টিপাত, বন্যা, তাপদাহ, দাবানল, খরা, উপকুলীয় অঞ্চলের ঘূর্ণিঝড় ও লবণাক্তটার ।

আমাদের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন রকমের কর্মকান্ডের সাথে যেমন বিদ্যুতের ব্যাবহার, গাড়ির জ্বালানি, কিংবা গ্যাস চুল্লি ইত্যাদি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে গ্রীনহাউজ গ্যাস, মুলত কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমনের সাথে জড়িত। এই ব্যাপারটি যদি আমরা বুঝি এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে এই গ্রীনহাউজ গ্যাস নির্গমনটি যদি কিছুটা হ্রাস করতে পারি তবে সম্মিলিতভাবে সেটি বিশাল প্রভাব ফেলবে।

জলবায়ু পরিবর্তন বন্ধে জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নীতিনির্ধারণের ভূমিকা সর্বাধিক হলেও, ব্যক্তি পর্যায়ের সম্মিলিত ভূমিকা কোন অংশে কম না । ব্যক্তি পর্যায়ে অনেক কর্মকাণ্ডই আমরা করতে পারি যেগুলো শুধু জলবায়ু পরিবর্তনকেই সামাল দিবে না বরং সাথে সাথে আপনার অর্থনৈতিক কিংবা শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও ভালো হবে । চলুন দেখি দশটি সেরকম কাজ – 

১)  হেঁটে কিংবা সাইকেলে চলুনঃ আপনার মন, শরীর এবং পৃথিবীর জন্য ভাল এমন আর কোন একক কাজ আছে কি? ছোটখাটো কিংবা কাছাকাছি দূরত্বের কোন কাজ করতে গাড়ির পরিবর্তে হেঁটে কিংবা সাইকেলে করে কাজটি করার চিন্তা করুন এতে আপনার শরীর-মন এমনকি পকেটের অবস্থাও ভালো হবে ।

জলবায়ু পরিবর্তন কমানো সহায়ক জীবনযাপন

২) মাংস কম খাওয়াঃ গবাদি পশু ও ভেড়া পালনের ফলে প্রচুর পরিমাণে মিথেন তৈরি হয়, যা একটি শক্তিশালী গ্রিনহাউস গ্যাস। মাংসের পরিবর্তে মাছ, ও ডিম খাওয়া যেতে পারে । বেশি বেশি লাল মাংস খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ভালো না । 

৩) খাবার নষ্ট না করাঃ বাড়িতে খাবার রান্না করলে খেয়াল রাখবেন খাবারটা যাতে নষ্ট না হয় । শুরুতেই যদি একটু চিন্তা করে নেন কতটুকু খাবার খাওয়া হবে না তা প্রথমেই সুন্দর করে রেফ্রিজারেটরে রেখে দিতে পারেন তাতে করে আপনার কষ্ট কমবে । আর খাবার উৎপাদন ও রান্নার সাথে জড়িত গ্রীনহাউজ গ্যাস নির্গমনের ব্যাপারটা তো থাকছেই । 

৪) গাড়ির টায়ারে হাওয়া ঠিক রাখুনঃ খেয়াল রাখবেন গাড়ির চাকায় পর্যাপ্ত পরিমাণে হওয়া আছে কিনা। অন্তত ৩/৪ সপ্তাহে একবার করে হাওয়া যন্ত্র দিয়ে পর্যবেক্ষণ করা উচিৎ । সঠিক পরিমাণে হাওয়া থাকলে গাড়ির জ্বালানির খরচ কমে। রাস্তায় কোথাও যদি অপেক্ষা করেন আর সেটা যদি ১০ সেকেন্ডের বেশি হয় এবং আপনি রাস্তায় ট্রাফিকে আটকা না থাকেন তবে ইঞ্জিন বন্ধ রাখাই জ্বালানির দিক থেকে সাশ্রয়ী।  

৫) বিমান যাত্রা কমানোঃ বিমান যাত্রা সীমিত করা, বা যেখানে সম্ভব সম্পূর্ণভাবে বিমান যাত্রা ত্যাগ করা সর্বোত্তম । যুক্তরাজ্যে বসবাসরত একজন সাধারন মানুষের সারা বছরের গ্রীনহাউজ গ্যাস নির্গমনের পরিমাণ হলো প্রায় ১০ টন কার্বন ডাই অক্সাইড আর সেই হিসেবে একজন বাংলাদেশী মাত্র ০.৫ টন ঐ গ্যাস নির্গমন করে । আর আপনি যদি একবার লন্ডন থেকে ঢাকায় রাউন্ড ট্রিপ বিমান যাত্রা করেন তবে প্রায় সোয়া ২ টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গমনের কারন হবেন ।

৬) এল ই ডি লাইট বাল্বঃ প্রথমে দেখুন বাড়িতে কোন গতানুগতিক বৈদ্যুতিক বাতি রয়েছে কিনা সেগুলো পরিবর্তন করে এল ই ডি লাইটবাল্ব লাগাতে পারেন । টেকসই এই বালগুলো একটু ব্যয়বহুল হলেও অন্যান্যবারের তুলনায় তারা ২৫ গুণ বেশি সময় ধরে চলতে পারে এবং কমপক্ষে ৭৫ শতাংশ কম বিদ্যুৎ শক্তি ব্যবহার করে ৷

জলবায়ু পরিবর্তন ও খরচ কমানো সহায়ক উপায়

৭) বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি আনপ্লাগ করে রাখুনঃ বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি যেমন ধরুন টিভি, কম্পিউটার, হেয়ার ড্রায়ার ইত্যাদি যখন ব্যবহার না করছেন তখন এগুলো আনপ্লাগ করে রাখুন । কেননা সমস্ত আবাসিক বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির শক্তি খরচের প্রায় এক-চতুর্থাংশ নিষ্ক্রিয় পাওয়ার মোডে ব্যবহৃত হয় । তাই যখন রাতে ঘুমাতে যাচ্ছেন কিংবা লম্বা সময়ের ছুটিতে যাচ্ছেন তখন সম্ভাব্য যন্ত্রগুলোকে আনপ্লাগ করে রাখলে আপনার বিদ্যুৎ খরচ সাশ্রয় হবে ।

৮) প্রোগ্রামেবল থার্মোস্ট্যাটঃ বাড়িতে যদি শীততাপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র কিংবা গ্যাস সেন্ট্রাল হিটিং ব্যবহার করেন তবে একটা প্রোগ্রামেবল থার্মোস্ট্যাট থাকলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে এর চালু বা বন্ধ হওয়া নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন, এতে করে আপনার বিদ্যুৎ খরচ কমবে, আর প্রকারান্তের গ্রীনহাউজ নির্গমন  হ্রাসের ব্যাপারটাতো থাকছেই । আরেকটা কাজ করতে পারেন, থার্মোস্ট্যাটে আপনার কাঙ্খিত তাপমাত্রার চেয়ে ১ ডিগ্রি কম (শীতে হিটিং সিস্টেমে) করে রাখতে পারেন এতে করে আপনার জ্বালানি খরচ বাঁচবে কিন্তু তাপমাত্রার অনুভূতিতে তেমন একটা টের পাবেন না ।  

৯) ঠান্ডা পানিতে কাপড় ধোয়াঃ আজকাল বেশিরভাগই লোকই বাসাবাড়িতে লন্ড্রি যন্ত্র ব্যাবহার করে কাপড় ধোয়ার কাজটি করেন এবং অনেকেই উষ্ণ পানির সেটিং দিয়ে কাজটি করেন । কিন্তু ঠান্ডা পানিতে ধোয়ার ব্যাপারটি উষ্ণ পানি ব্যবহারের মতোই কার্যকর। আর জানেন কি এই লন্ড্রিগুলো পানি উষ্ণ করতে গিয়েই বিদ্যুতের ৭৫ ভাগ খরচ করে । আর যদি পারেন কাপড় শুকানোর সময় লন্ড্রি ব্যবহার না করে স্বাভাবিক ভাবে বাহিরে টাঙ্গিয়ে শুকিয়ে নিতে পারলে অনেক বিদ্যুতিক খরচ বাঁচবে । 

১০) এনার্জি রেটিং দেয়া বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদিঃ বাড়িতে পরবর্তীতে যখন কোন নতুন বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি যেমন রেফ্রিজারেটর, ডিশওয়াশার কিংবা লন্ড্রি যন্ত্র প্রতিস্থাপন করতে যাবেন তখন খেয়াল রাখবেন নতুন যন্ত্রগুলো যেন কম বৈদ্যুতিক শক্তিতে চলে । বর্তমানের বেশিরভাগ বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদির গায়েই এনার্জি রেটিং দেয়া থাকে । যদিও কেনার সময় সামান্য বেশি বিনিয়োগ করতে হতে পারে, কম শক্তি খরচ করা এই সরঞ্জামাদিগুলো টেকসইও হয়, আর লম্বা সময়ে বিদ্যুৎ খরচ সাশ্রয়ের ব্যাপারটা তো থাকছেই ।

জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য মূলত আমরা সবাই কম বেশি দায়ী আর এর খারাপ দিকগুলো আমরা সবাই কম বেশি ভোগ করব। পৃথিবী ও অন্য মানুষের কথা চিন্তা করে দৈনিক অন্তত একটা কাজ করুনঃ যেমন, অপ্রয়োজনীয় বাতি ও ফ্যান বন্ধ রাখলেন, কিংবা দাঁত ব্রাশের সময় বিনা দরকারে পানির খরচ না করলেন। আমরা যদি অল্প একটু করেও কাজ করি, তবে সম্মিলিতভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের গতি একটু কমবেই ।  

লেখকঃ মোহ বাঙ্গালি

About সময় চাকা

আমরা বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসরত কিছু বাংলাদেশী। সময়ের চাকায় আমরা চলেছি সুখের সন্ধানে, সেই প্রস্তর যুগ থেকে শুরু করে আজও চলছে সন্ধান আর অনুসন্ধান । তাই চলুন সময়ের চাকায় পিষ্ট না হয়ে, সময় চাকা ধরে চলতে থাকি, সময়কে সুন্দর করে রাখার আশায়…

One thought on “জলবায়ু পরিবর্তন বন্ধে ১০ টি কাজ যা কিনা ব্যক্তি পর্যায়েও অর্থনৈতিক এবং স্বাস্থ্য সুবিধা দিবে ।

  1. সুন্দর লিখেছেন, সবার অনুসরণ করা উচিৎ। তাতে করে সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। ধারাবাহিকতা বজায় রাখুন, সাফল্য কামনা করি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *