সুখী জীবনের ১০ ভিত্তি

সবাই সুখী হতে চায় কিন্তু এটি নির্ভর করে মানুষ তার আবেগের ওপর কতটা ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে। ইতিবাচক মনোবিজ্ঞানের সমসাময়িক গবেষনা বলছে সুখ হচ্ছে বেছে নেওয়ার বিষয় ।  আর এ গবেষণা গুলোকে সুন্দর ও খুব সহজগম্য করে একত্র করেছেন ভ্যানেসা কিং তাঁর টেন কী টু হ্যাপিয়ার লিভিং বইটিতে যা আপনাদের সাথে সংক্ষেপে শেয়ার করব।  ভ্যানেসা কিং হলেন একশন ফর হ্যাপিনেসের বোর্ড সদস্য এবং যুক্তরাজ্যের ইতিবাচক মনোবিজ্ঞানের অন্যতম শীর্ষ বিশেষজ্ঞ। তিনি দশ ধরনের কর্মকাণ্ডের সাথে আমাদের সুখের সংযোগের সর্বশেষ বৈজ্ঞানিক গবেষণার উপর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন আর দেখিয়েছেন কীভাবে আমরা ঘরে, কর্মক্ষেত্রে এবং আরও বৃহৎ পরিসরে সেগুলি ব্যবহারিক ক্রিয়াকলাপ ও দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োগ করেতে পারি । বইটি একটি সুখী, আরও পরিপূর্ণ ও যত্নশীল জীবনযাপনের জন্য একটি দুর্দান্ত মেনু ।

সুখকে আপাত দৃষ্টিতে আনন্দ বা তাৎক্ষনিক সন্তুষ্টি বোধের সাথে মিশিয়ে ফেলা হয়, কিন্তু এটি জীবনের তৃপ্তি, বৈষয়িক সমৃদ্ধি, বিকাশ এবং সুস্থতার সঙ্গেও জড়িত। সুখ শুধুই অভ্যন্তরীণ বা বাহ্যিক অভিজ্ঞতা নয়, বরং উভয়ই হতে পারে । আর দশটি কর্মকাণ্ডের প্রথম পাঁচটিই আমাদের প্রতিদিনের বাহ্যিক ক্রিয়াকলাপ ও পরিপার্শ্বিক পরিবেশের সাথে সম্পর্কিত আর দ্বিতীয় পাঁচটি আমাদের অভ্যন্তরীণ চিন্তাচেতনা ও জীবনের প্রতি আমাদের মনোভাবের উপর নির্ভর করে।

১) অন্যের যত্নের প্রতি মনোযোগী হওয়া

অন্যকে সহায়তার করা এবং সুখ বোধের মধ্যে যে সংযোগ রয়েছে তা একটি বিজ্ঞানিক সত্য । অন্যকে সহায়তা করা কেবল যে সাহায্য প্রাপ্ত ব্যক্তির পক্ষে ভাল তা নয় বরং এটি সাহায্যকারীকেও সুখী করে তোলে। এটি শুধু অর্থই হতে হবে তা নয়, হতে পারে একটু সময় দেয়া, কোন কাজের উপায় বাতলে দেয়া, ক্ষমা করে দেয়া, কাউকে মনোযোগ দেয়া, মনের সাহস দেয়া ইত্যাদি সহ আরো ছোটখাটো অনেক বিষয় ।

২) সম্পর্কই সুখের মূলমন্ত্র

সম্পর্কই বস্তুত আমাদের অস্তিত্ব আর সুখী জীবনের মূলমন্ত্র। পরিবারে মুখ্য সম্পর্কগুলি বাবা-ছেলে, বাবা-মেয়ে, মা-ছেলে, মা-মেয়ে এবং অবশ্যই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তৈরি হয়। পরিবার এবং বন্ধুদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ও তার সমর্থন আমাদের মূল্যবোধ বাড়ায় আর তৈরি করে সুখী, স্বাস্থ্যবান এবং দীর্ঘকাল বেঁচে থাকার পরিমণ্ডল। আমাদের এই সম্পর্কগুলোকে শক্তিশালী করতে এবং নতুন সংযোগ তৈরি করতে কাজ করতে হবে । এমনকি আপাতদৃষ্টিতে ছোট, ঘটনামূলক মিথস্ক্রিয়া যেমন একটি বন্ধুত্বপূর্ণ হাসি বা সদাচরণও একটি পার্থক্য তৈরি করতে পারে, প্রভাবিত করতে পারে সবার সুখকে। মনে রাখতে হবে সুখী বন্ধুর বন্ধুও সুখী হয়।

৩) শরীরের যত্ন নেয়া

শরীরই আমাদের মনের বাসা আর সুখের ঘর। সক্রিয় থাকা আমাদের সুখের পাশাপাশি আমাদের শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্যও ভাল। এটি তাত্ক্ষণিকভাবে আমাদের মেজাজকে ভাল করে এবং এমনকী আমাদের হতাশাকেও ভুলিয়ে দিতে পারে । আমাদের সকলকে ম্যারাথন করার দরকার নেই – প্রতিদিন আরও বেশি সক্রিয় হওয়ার সহজ অনেক উপায় রয়েছে যেমন বাহিরে সূর্যের  আলোতে যাওয়া,  প্রযুক্তি থেকে ব্রেক নেয়া, একটু হাটা, পর্যাপ্ত ঘুমানু ইত্যাদি ।  তবে সপ্তাহে দুদিন জোর ব্যায়াম করা উচিৎ আর তা যদি কোন পরিবার এবং বন্ধুদের সাথে করতে পারেন তাহলে উপকার বহুবিদ ।

 ৪) জীবনে উপস্থিত থাকতে হবে

অতীত ও ভবিষ্যৎ গুরুত্বপূর্ণ তবে জীবনজজ্ঞ থাকে বর্তমানে । সুখী হতে আমাদেরকে থাকতে হবে বর্তমানে কিন্তু সেটা হতে হবে স্থান ও কাল দুইয়ের বিচারে আর অনুভূতিগুলি থাকতে হবে সচল যাতে অনুভব করতে পারি সেখানকার তখনকার সৌন্দর্য, বরন, গন্ধ, স্পর্শ সহ সব ।

বর্তমান সময়ে কী ঘটছে সে সম্পর্কে মনোযোগী এবং সচেতন থাকা সুখ আর মজ্ঞলের জন্য খুবই প্রয়োজন যদিও আজকের ব্যস্ততা, বহু-কাজ করার বিশ্বে তা আপাত কঠিন মনে হতে পারে ।

৫) নতুন জ্ঞান মঙ্গলময়

পড়াশোনা প্রচুর ইতিবাচক উপায়ে আমাদের সুখ ও মঙ্গলকে প্রভাবিত করে। এটি আমাদের নতুন ধারণা দেয় আর কৌতূহল মিঠায়, বাড়ায়   আমাদের আত্মবিশ্বাস ও স্থিতিশীলতা । নতুন জিনিস শেখার অনেকগুলি উপায় রয়েছে – কেবল আনুষ্ঠানিক শিক্ষাই না। আমরা বন্ধুর দক্ষতা শেয়ার করতে পারি, কোন ক্লাবে যোগ দিতে পারি, অন-লাইনে কিছু শিখতে পারি, গান শিখতে পারি, নতুন খেলা খেলা সহ আরও অনেক কিছু করতে পার।

ভ্যানেসা কিং এঁর টেন কী টু হ্যাপিয়ার লিভিং বই (10 Keys to Happier Living by Vanessa King)

৬) লক্ষ্য থাকতে হবে

ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাল অনুভব করা সুখের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সবাইকে অনুপ্রাণিত করার জন্য দরকার যথেষ্ট চ্যালেঞ্জীং কিন্তু অর্জনযোগ্যও লক্ষ্য । আমরা যদি অসম্ভবকে জয় করার চেষ্টা করি তবে এটি অনাবশ্যক চাপ নিয়ে আসবে। উচ্চাভিলাষী কিন্তু বাস্তবায়নযোগ্য লক্ষ্য নির্বাচন আমাদের দিকনির্দেশনা দেয় এবং আমরা যখন তা অর্জন করি তখন তৃপ্তির অনুভূতি নিয়ে আসে।

৭) ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি

জীবন হতাশা, ক্ষতি, ব্যর্থতা বা ট্রমা থাকেই। তবে আমরা কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাব তা আমাদের সুখের উপর প্রভাব ফেলবে। মনে রাখতে হবে প্রায়শই ঘটনার উপর আমাদের কোন হাত থাকেনা তবে যা ঘটে তার প্রতি কি প্রতিক্রিয়া দেখাব তা আমরা বেছে নিতে পারি।

চাপ বা অসুবিধার সময় ভেঙে যাওয়ার পরিবর্তে ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষমতা বা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়ার সময় অবিচল থাকার এবং মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা আমাদের আরও উন্মুক্ত করতে এবং নতুন সুযোগ গ্রহণ করতে ইচ্ছুক হতে সহায়তা করে। পরিবার, বন্ধুবান্ধব, প্রতিবেশী এবং কাজের সহকর্মীদের মতো অন্যান্য ব্যক্তির সাথে আমাদের সম্পর্কের নেটওয়ার্ক আমাদের ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি যোগাতে সহায়তা করে ।

৮) ইতিবাচক মনোভাব রাখা

আনন্দ, কৃতজ্ঞতা, তৃপ্তি, অনুপ্রেরণা এবং গর্বের মতো ইতিবাচক আবেগগুলি কেবল দুর্দান্ত নয় বরং সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে দেখা যায় যে নিয়মিত এসব অভিজ্ঞতা আমাদের রোমাঞ্চিত করে ।  সুতরাং যদিও আমাদের জীবনের উত্থান-পতন সম্পর্কে বাস্তববাদী হওয়া দরকার তবে ইতিবাচক মনোভাব রাখতে হবে অর্থাৎ গ্লাস অর্ধেক খালি না হয়ে অর্ধেক পূর্ণ বলা। সুখ সম্পর্কে চিন্তাভাবনার একটি কার্যকর উপায় হলো সামগ্রিকভাবে নেতিবাচক আবেগের তুলনায় ইতিবাচক আবেগ বেশি থাকা যা পজিটিভিটি রেশিও বলে  পরিচিত। নেতিবাচক আবেগ অনুভব প্রকৃতপক্ষে জীবনেরই অংশ – এমনকি প্রতিটি দিনের অংশ – তবে আমাদের সঠিক ভারসাম্য অর্জন করা প্রয়োজন।

৯) সীমাবদ্ধতা জেনে স্বদোষারূপ এড়িয়ে চলা

কেউই নিখুঁত না, সবারই সীমাবদ্ধতা আছে। অনেক সময়ই আমরা নিজের ত্রুটি নিয়ে সবিস্তারে ভাবি কিন্তু নিজের সীমাবদ্ধতা চিন্তা করলে হয়তো ঐটি কোন ত্রুটি না। আমরা যা করতে পেরেছি তার চেয়ে আমরা কী করছি না এধরনের চিন্তা খুশি হওয়াকে আরও কঠিন করে তোলে।

যখন কোন ভুল হয়ে যায় তখন নিজের সাথে দয়াবান হওয়া, শুধু শুধু নিজেকে দোষারূপ না করা, আমাদের জীবন উপভোগ করতে ও ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। এটি আমাদের অন্যদেরকেও তাদের সীমাবদ্ধতাসহ মেনে নিতে সহায়তা করে।

১০) বড় কিছুর অংশ হওয়া অর্থাৎ জীবনের উদ্দেশ্য জানা

জীবনের ‘অর্থ এবং উদ্দেশ্য’ কি? নিজেকে জিজ্ঞাস করুন। মানুষই কেবল জীবনের উদ্দেশ্য নির্ধারণ করতে পারে । তা ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে হতে পারে, পিতা-মাতা হওয়া কিংবা কোন মহৎ কাজ করা হতে পারে অর্থাৎ নিজের চেয়ে বড় কিছুতে যুক্ত থাকা। যাদের জীবনে অর্থ এবং উদ্দেশ্য রয়েছে তারা সুখী, তারা জীবনের প্রতি নিয়ন্ত্রণ বেশি বোধ করে এবং এমনকি কম চাপ, উদ্বেগ এবং হতাশাও অনুভব করে।

ফিচার ফটোঃ pixabay.com

লেখকঃ মোহ বাঙ্গালি [আপনি যদি এই সম্পর্কে আরো পড়তে চান এখানে বইটির লিঙ্ক]

About সময় চাকা

আমরা বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসরত কিছু বাংলাদেশী। সময়ের চাকায় আমরা চলেছি সুখের সন্ধানে, সেই প্রস্তর যুগ থেকে শুরু করে আজও চলছে সন্ধান আর অনুসন্ধান । তাই চলুন সময়ের চাকায় পিষ্ট না হয়ে, সময় চাকা ধরে চলতে থাকি, সময়কে সুন্দর করে রাখার আশায়…

2 thoughts on “সুখী জীবনের ১০ ভিত্তি

  1. এই অসাধারণ কিছু উপায় যা সত্যিই আমাদের সাহায্য করবে সুখী জীবনের পথ চলায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *